প্রবাসী রংপুরীদের চেতনার রংপুর
রিফাত রহমান শাকিল, সুইডেন থেকে
প্রথম বিদেশে আসার দিনটা এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৬, চোখের জল মুছে ইতিহাদ এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইট এ উঠছি, পিছনে ফেলে আসছি বাবা-মা'র চোখের জল, প্রিয় দেশ আর আমার প্রিয় শহর রংপুরকে। যারা কখনো বিদেশে যায়নি এই অনুভুতিটা তারা কখনো উপলব্ধি করতে পারবেনা যে সে সময়টায় মনের মধ্যে দেশের প্রতি কতোখানি ভালবাসা জেগে ওঠে। আর আমরা রংপুরের মানুষতো স্বভাবগতভাবেই একটু বেশী আবেগপ্রবণ। যে শহরে আমি বড় হয়েছি, যে শহর আমার শৈশবের সব স্মৃতি জমা করে রেখেছে, আমি সেই শহরকে দুরে ফেলে হাজার হাজার মাইল দুরের বিলেতে চলে যাচ্ছি……………..। বিদেশে আসার সময় যে আবেগকে বুকে চাপিয়ে রেখে বিদেশে এসেছিলাম সেটা কিন্তু আজও অমলিন। এখনও সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথমেই জানতে ইচ্ছে করে আমার পরিবারের কথা, আমার প্রিয় শহরটির কথা, আমার প্রিয় দেশটার কথা। ইন্টারনেটের কল্যানে সব খবরগুলো খুব দ্রুত পেয়ে যাই, ভাল কোন খবর পেলে যেমন মনটা ভাল হয়ে যায় ঠিক সেভাবেই খারাপ সংবাদ পাওয়ার পর মনটা ভরে ওঠে বিষন্নতায়।
বিদেশে এসে খুঁজে বেড়াই রংপুরের মানুষকে; দেশ থেকে কেউ আসছেন কিনা; কেউ দেশে যাচ্ছেন কিনা এসবের মধ্যে বিদেশের মাটিতে প্রিয় শহরটার সান্নিধ্য পাওয়ার অফুরন্ত চেষ্টা রংপুর থেকে আসা সব প্রবাসীদের মধ্যেই। এভাবেই আমরা প্রবাসীরা ধীরে ধীরে মিলিত হতে শুরু করেছি একসঙ্গে। কদিন আগে রংপুর সিটি কর্পোরেশন মেয়র মানিক চাচা ফোন করে জানালেন তিনি অষ্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন, সেখানে রংপুরের কেউ থাকলে চাচা সুযোগ করে তাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন। আমি পরদিনই চাচাকে জানালাম অষ্ট্রেলিয়াতে মুলাটোলের নাজু আর বিপু ভাই আছেন, আর নিউজিল্যান্ডে আছেন ষ্টেশন রোডের জাহিদ ভাই। এরপর নাজু, বিপু ভাই আর জাহিদ ভাইকে মেয়র চাচার কথা জানানোর পর তারা অধীর আগ্রহ নিয়ে চাচার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। মেয়র চাচা অষ্ট্রেলিয়াতে পৌঁছানোর পর নাজু আর বিপু ভাই চাচাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেয়ে সেদিনই চাচার সঙ্গে ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করলো আমাকে নিশ্চিত করার জন্য যে তারা অষ্ট্রেলিয়াতে বসেই মেয়র চাচার সান্নিধ্য পেয়েছে।
ছবি: নাজু ও বিপুভাইদের অষ্ট্রেলিয়ার বাসায় রংপুর সিটি কর্পোরেশন মেয়র মানিক চাচা
চাচা কবে নিউজিল্যান্ডে যাবেন সেটা জানার জন্য অস্হির হয়ে জাহিদ ভাই আমাকে রাত-দিন ফোন করতে থাকলো। চাচা নিউজিল্যান্ড এ যেখানে যাবেন সেখান থেকে জাহিদ ভাইয়ের বাসা ৫/৬ ঘন্টার বাস জার্নি করে যেতে হয়। তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাহিদ ভাই চাচার সান্নিধ্য পায়নি। এজন্য আজও জাহিদ ভাই দুঃখ করে বলেন যে চাচা নিউজিল্যান্ডে থাকাকালীন চাচার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হলনা তার। এই বোধ, এই আবেগ, এই ভালবাসা কাজ করে রংপুরের প্রতিটি মানুষের জন্য। আর সেজন্য আমরা খুঁজে ফিরি একজন আর একজনকে, নিজের শহরের মানুষকে।
আমরা অবচেতন মনেই রংপুরের মানুষের জন্য অপেক্ষা করি, রংপুরের থাকা অবস্হায় রংপুরের যাকে চিনতাম না, জানতাম না, সেই মানুষটাকেই বিদেশের মাটিতে পেয়ে মনে হয় যে দীর্ঘদিনের পরিচিত কাউকে কাছে পেয়েছি, কাছে পেয়েছি আমার প্রিয় শহরের সান্নিধ্য। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা যেমন সিলেট বা নোয়াখালীর তুলনায় বিদেশে রংপুরের মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না। তবে এরপরেও অনেক দেশেই এখন রংপুরের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। রংপুরের মানুষ ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। আমি ইংল্যান্ড থেকে সুইডেন আসার পর জানতে পেরেছি এখন ইংল্যান্ডেও রংপুরের বেশকিছু মানুষ দেখা যায়, এমনকি তারা 'বৃহত্তর রংপুর সমিতি' নামক একটা সংগঠনও দাড় করিয়েছে। ২০০৬/২০০৭ সালেও লন্ডনের রাস্তায় রংপুরের মানুষ চোখে পড়তোনা তেমন একটা, অথচ আজ সেখানে প্রবাসী রংপুরীরা একটা সংগঠন খুলে ফেলেছে।
আমি ইংল্যান্ড থেকে সুইডেনে চলে আসি ২০১০ সালে। সুইডেন আসার পর আমার মাথায় রংপুর নিয়ে একটা চিন্তা কাজ করতে শুরু করলো তা হলো প্রবাসী রংপুরীদেরকে কিভাবে একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। প্রবাসী রংপুরীদের একত্র করার চিন্তাটা প্রথম আসে এ বছরের প্রচন্ড শীতের সময় যখন দুঃস্হ মানুষগুলো কষ্ট পাচ্ছিল তাদের কথা ভেবে। রংপুর থেকে রিয়াদ আনোয়ার শুভ ভাই ফেইসবুকে প্রচন্ড শীতের বিষয়টা জানানোর পর স্পেন থেকে অপু ভাই কিছু টাকা পাঠিয়ে দিল, আমিও কিছু দিলাম। সঙ্গে অন্যান্যরা মিলিয়ে মোটামুটি যা পাওয়া গেল সেটা দিয়েই শুভ ভাই এলাকার ছেলেদের নিয়ে গরীবদের জন্য শীতবস্ত্র কিনে দিল। শীতে কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়, প্রতি বছর শীত আসে আর একইভাবে আমাদের দুঃস্হ মানুষগুলো কষ্ট পায়। অথচ সিলেটের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাদের যেকোন দুরাবস্হায় সিলেটি প্রবাসীরা সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের এলাকার প্রতি যে টান, এলাকার মানুষদের প্রতি যে অনুভুতি সেটা অকল্পনীয়। এটাইতো মানবিকতা, নিজের এলাকার মানুষের কল্যানেই যদি না এলাম তাহলে আমার মধ্যে মানবিকতা বলেতো কিছুই থাকলোনা। আমি সিলেটের প্রবাসীদের শ্রদ্ধা জানাই তাদের মানবিকতার জন্য। এই মানবিকতা ধরে রাখতে পেরেছে বলেই সিলেটের মানুষ আজ লন্ডনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে, প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে নিজেদের।
আমি আমার সব পরিচিত প্রবাসীদের নিয়ে ফেইসবুকে এ বছরের এপ্রিল মাসে একটা গ্রুপ চালু করলাম 'প্রবাসী রংপুরী' নামে। মাত্র কিছুদিনের মধ্যে সেই গ্রুপে মেম্বার সংখ্যা হয়ে গেল ৮০ জন। আমেরিকা থেকে মুন্সিপাড়ার শুভ ভাই, অষ্ট্রেলিয়া থেকে সার্কিট হাউসের তৌফিক, ইংল্যান্ড থেকে মুন্সিপাড়ার ফয়সাল ও মেহেদী, স্পেন থেকে আদর্শ পাড়ার অপু ভাই সহ অনেকে অনেক দ্রুত প্রবাসী রংপুরীদের গ্রুপে জয়েন করালেন। সার্কিট হাউসের রিয়াদ আনোয়ার শুভ ভাই প্রবাসী না হয়েও প্রবাসী রংপুরী খুঁজে পেতে অনেক সাহায্য করলেন। আমাদের উদ্দেশ্য হলো প্রবাসী রংপুরীদের একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা। আমরা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় শহরকে দারিদ্রমুক্ত করতে চাই। আমরা একটা সুন্দর, সুখী রংপুর গড়ে তুলতে চাই। আমাদের গ্রুপ ওপেন রাখা হয়েছে সকল প্রবাসীদের জন্য। দেশের বাহিরে থাকা যে কেউ এই গ্রুপের সদস্য হতে পারবেন। যাদের ফেইসবুকে আইডি আছে তারা সরাসরি Rangpurian Overseas (প্রবাসী রংপুরী) সার্চ দিয়ে গ্রুপে জয়েন করতে পারেন। যাদের ফেইসবুক আইডি নেই তারা ই-মেইল এ যোগাযোগ করতে পারেন। ই-মেইল: rifat218@yahoo.com, rifat218@gmail.com. 'প্রবাসী রংপুরী' গ্রুপের কাজ এখনও প্রক্রিয়াধীন। গ্রুপটির মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রবাসজীবনের একাকীত্ত্ব, খারাপ লাগা, ফেলে আসা শহরের স্মৃতি ভাগাভাগি করি। যাদের ফেইসবুক আইডি নেই তাদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করার চেষ্ঠা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অবশ্য অনেকের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে গ্রুপের আর্কাইভে রাখা হয়েছে।
সকল প্রবাসী একেকজন যোদ্ধা। প্রবাসজীবনে আমরা সকলেই যুদ্ধ করছি। এই যুদ্ধ শুধু নিজের জন্য নয় বরং একটি দেশের জন্য প্রতিনিয়ত আমরা যুদ্ধ করছি আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে। আমাদের এই যুদ্ধ তখনই সফল হবে যখন দেখতে পারব দেশে আমাদের সকলের পরিবারের সদস্যরা ভাল আছেন, নিরাপদে আছেন, যখন জানব আমাদের কোন গরীব আত্মীয় বা পাশের বাসার পরিবারটিকে না খেয়ে থাকতে হচ্ছেনা। আমরা সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি, যেদিন আমাদের প্রিয় রংপুরে থাকবেনা কোন ক্ষুধার কষ্ট, শীতের সময় ঠান্ডায় কষ্ট পাবেনা কেউ, প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার যেদিন নিশ্চিত হবে, আমরা প্রবাসী রংপুরীরা অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই স্বপ্নের দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি।