একজন মজিবর রহমান রবি ও আমাদের তরুন সমাজ
রিফাত রহমান শাকিল, সুইডেন থেকে
আজ থেকে ২৬ বছর আগের কথা। ১৯৮৫ সালে একজন লোক নাটক লিখতেন। লোকটা সুস্হ্য নন, পক্ষাগাত রোগে আক্রান্ত। হাত-পায়ের হাড় বেঁকে গেছে, লিখতে অনেক কষ্ট হয়, তবুও লেখেন, যা লেখেন তাই অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর আর ঝকঝকে লাগে দেখতে। তার লেখাগুলো সুন্দর হয়ে ওঠার কারন দুটি । প্রথমত তার সুন্দর হাতের লেখা আর দ্বিতীয়ত সমাজের অস্হিরতাকে তিনি নাটকের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। আমি তখন মাত্রই ৫ বছরের একটা বাচ্চা; কিছুই বুঝিনা; কিন্তু সুন্দর হাতের লেখার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। সুযোগ পেলেই তার ঘরে ঢুকে তার লেখাগুলো দেখতাম । এই লোকটি আমার মেজ চাচা, মজিবর রহমান রবি, 'রবি' নামটা অবশ্য নিজের লাগানো, কারন তিনি রবিঠাকুরকে পছন্দ করতেন অনেক বেশী । আমার মেজ চাচা তার অসুস্হ্য শরীর নিয়ে শুধু নাটক বা কবিতাই লিখতেন না, ছবি আঁকতেন, ঘুড়ি বানাতেন । সেই ঘুড়িগুলো ২/১ টাকা করে পাড়ার ছেলেদের কাছে বিক্রি করতেন । কারন তার জীবিকা নির্বাহের কোন রাস্তা খোলা ছিলনা । মেজ চাচা ১৯৭০ সালে প্রথম বিভাগ নিয়ে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্টিক পাশ করে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, এরপর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সেই কলেজ থেকেই ডিগ্রী পাশ করেন । ছাত্র হিসাবে মেধাবী থাকার কারনে পাশ করেই ব্যংকে চাকরী পেয়ে যান, কিন্তু তার ভাগ্য এতোটাই খারাপ যে চাকরীতে যোগদান করার আগের রাতেই পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন । পা বাঁকা করে হাঁটতেন, তাই পাড়ার লোকজন তাকে বিদ্রুপ করে ন্যংড়া বলেও ডাকত । তিনি এসবকে ঘুনাক্ষরেও গুরুত্ব দিতেন না, বরং অসুস্হ্য হবার পরে লেখালেখি করার অনেক সুযোগ পেয়েছেন বলে তাকে আনন্দিতই মনে হতো !
শিল্প-সংস্কৃতিতে আমাদের রংপুর দীর্ঘদিন ধরেই একটা পরিচিত নাম, এই রংপুর জন্ম দিয়েছে অনেক গুনী সাহিত্যিক, নাট্যকার কে । মজিবর রহমান রবি তাদেরই একজন । যিনি তার শেষ জীবন কাটিয়েছেন মুন্সিপাড়ার একটা ভাঙ্গা ঘরে বাস করে, টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেননি, কিন্তু কখনই মানুষের কাছে হাত পাতেননি, নাটক মঞ্চায়ন করে বা নিজের বানানো ঘুড়ি বিক্রি যা পেতেন সেটা দিয়েই কষ্ট করে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতেন । পাড়ার ছেলেদের ব্যস্ত রাখতেন শিল্প চর্চার মাধ্যমে । প্রায় প্রতিবছর কেরামতিয়া হাইস্কুল মাঠে আয়োজন করতেন নাটকের, আর তার নাটকের নির্দেশক হিসাবে থাকতেন তারই বন্ধু প্রাক্তন পৌরসভা চেয়ারম্যান জুন্নুন চাচা । নাটককে ঘিরে চলতো রিহার্সেল, পাড়ার তরুণ সমাজ অনেক উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে । বড় নাটক গুলো মঞ্চায়ন করা হতো টাউনহলে ।
২৬ বছর আগে যে রংপুরে নাটক নিয়ে পাড়ায় অনুষ্ঠান হতো কেমন আছে এখন সেই রংপুর? কেমন আছে রংপুরের তরুন সমাজ? যে রংপুরে একজন পঙ্গু লোক বেঁকে যাওয়া হাত দিয়ে নাটক লিখে তরুন সমাজকে খারাপ কাজ থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিল এখনও কি আমাদের প্রিয় রংপুর তেমনটাই আছে? আমার জানামতে রংপুরের কোন পাড়ায় এখন আর মঞ্চনাটক হয়না, নতুন প্রজন্ম ভাবতেই পারেনা যে তাদের আগের প্রজন্ম কতোবেশী প্রগতিশীল, আর শিল্প-সাহিত্যমনস্ক ছিল ! তরুণদের আজকের অবস্হার সব দায়ভার আমাদেরই । আমরা আমাদের স্বার্থে তরুনদের ভালকাজ থেকে দুরে সরিয়ে এনে বিষাক্ত রাজনীতির বেড়াজালে বন্দী করে রেখেছি, খেলার মাঠের বদলে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি মাদকদ্রব্য, পাড়ার একটা ছেলে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে অথচ আমরা সচকিত নাগরিক সমাজ সেটা দেখেও না দেখার ভান করছি, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কোন দায়িত্ব আমরা নিতে চাইনা।
মেজ চাচা ১৯৯১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং সে বছরই ২১ ডিসেম্বর রাতে মৃত্যুবরণ করেন। এই অস্হির সময়টাতে মেজ চাচাকে খুব মনে পড়ে । আমাদের কিছু মজিবর রহমান রবি দরকার, শুধুমাত্র তারাই পারেন আবার আমাদের তরুন সমাজকে এই মহাবিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে । আমি রংপুরে একজন মজিবর রহমান রবির জন্য অপেক্ষা করছি ।
No comments:
Post a Comment